দিল্লি ভ্রমণ: পশতু অভিজাত পুরুষ ইসা খান নিয়াজির সমাধি

২০০০ বছরের ঐতিহ্য সমৃদ্ধ দিল্লিতে ছোট-বড় মিলিয়ে কম করে হলেও ১০০০টি পুরাতন সমাধি রয়েছে। যেগুলোর অধিকাংশই বিভিন্ন সময়ে উপমহাদেশ শাসন করা তুর্কি, আফগান, খিলজী, তুঘলক, লোদী ও মোঘলদের আমলে নির্মিত। দিল্লির পাহাড়গঞ্জের একটি হোটেল থেকে সকাল সকাল বের হলাম। পুরো দিল্লি ভ্রমণের বেশিরভাগ সময়ই আমরা মেট্রো রেল দিয়েই যাতায়েতের কাজটি করেছি। নিউ দিল্লি মেট্রো স্টেশন থেকে জওহরলাল নেহেরু মেট্রো স্টেশনে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় লাগলো না। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে কিছু দূরেই নিজাম উদ্দিন আউলিয়ার দরগাহ এবং দরগাহ দর্শনের মাধ্যমেই দিনের ভ্রমণ কার্য শুরু হল।

আতর-গোলাপ সমৃদ্ধ বাহারি রঙ-এর চাদরে মোড়ানো দরগাহ দেখার পর সোজা হাটাঁ শুরু করলাম। লোদী রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে পাশেই চোখে পড়ল বড়খাম্বা সৌধ ও সেখান থেকে কিছু দূর গেলে নিজামুদ্দিন সার্কেলের মাঝে নীল রং-এর একটি গম্বুজ। পরে জেনেছিলাম এটা নীল গম্বুজ নামেই পরিচিত। মুটামুটি ১০/১২ মিনিট হাঁটার পর আমারা উপস্থিত হলাম মুঘল সম্রাট হুমায়ুনের সমাধি কমপ্লেক্সে। ইসা খান নিয়াজির সমাধিটি হুমায়ুন সমাধি কমপ্লেক্সের ভেতরেই অবস্থিত।

ইসা খান নিয়াজির সমাধির প্রবেশপথ। ছবি তুলেছেন Anupamg

হুমায়ুনের সমাধি কমপ্লেক্সের প্রবেশমুখে চেকিং পার হয়ে দু কদম এগুলেই ডানেদিকে পরবে ইসা খানের সমাধি। দুপাশে সবুজ ঘাসের লন পার হয়ে আমরা সমাধির প্রবেশপথে উপস্থিত হলাম। ঢোকার মুখেই মনুমেন্ট সম্পর্কিত শিলালিপি রয়েছে। ইসা খান নিয়াজি, সুরি সম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা শের শাহ সুরি ও তার পুত্র ইসলাম শাহ সুরির কোর্টের একজন জ্ঞনী ও প্রভাবশালী লোক ছিলেন। নিয়াজিরা আরেক প্রভাবশালী শাসকগোষ্ঠী লোদীদের গোত্রীয়। ১৫৪৭-৪৮ সালে ইসা খান জীবিত থাকা অবস্থাতেই নিজের এই সমাধিটি তৈরি করেন। পুরো সমাধি কমপ্লেক্সটি চারপাশে দেয়াল দ্বারা আবৃত। ভিতরের দিকে দেয়ালগুলোর মাঝে খোপ খোপ করা রয়েছে। ১৫৪৮ সালে ৯৫ বছর বয়সে দাপটের সাথে পৃথিবীতে বিরচরন করার পর তার নিজের তৈরি এই সমাধিতেই সমাধিস্থ হন আফগান এই ক্ষমতাধর ব্যক্তি। শিলালিপি পড়া শেষ করে ভেতরে এসে দাঁড়ালাম।
ইসা খান নিয়াজি এই ভবনের ভেতরেই সমাধিস্থ হয়েছেন।

ভেতরের দিকে ঢুকার মুখে দাঁড়ালেই এক পলকে সমাধি, তার চারপাশের অষ্টাভূজাকৃতির বাগান ও পাশের মসজিদটিসহ পুরো কমপ্লেক্সটি দেখে নেওয়া যাবে। ২০১১ সালে বিভিন্ন অংশ রিস্টোর করার পর এটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ঢোকার মুখ থেকে দু/তিনটি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলাম, এটাই মূল গ্রাউন্ড। প্রথম দেখাতে কমপ্লেক্সটি আমার কাছে — আমাদের দেশে গ্রামে একটি বাড়িতে নতুন ঘর তৈরির সময় মাটি ফেলে জায়গাটা উঁচু করার পর সেখানে ঘরটি তৈরি হয় কিন্তু তখন উঠানের জায়গাটি নিচু হয়ে যায় — টোম্ব ও পাশের মসজিদটিও ঠিক এমনভাবে উচুঁ শক্ত পাটাতনের উপর দাঁড়িয়ে আছে। এর চারপাশের অষ্টাভূজাকৃতির নিচু যে বাগান রয়েছে, এই ধরণের বাগানকে নাকি ‘সাংকেন গার্ডেন’ নামে ডাকা হয়। ইতিহাস ঘেঁটে জানা গেল, ইসা খানের সমাধির এই সাংকেন গার্ডেনটিই ভারতের সবচেয়ে পুরাতন সাংকেন গার্ডেন।
সমাধি ভবনের ভেতরের কবরসমূহ। ছবি তুলেছেন Anupamg

সমাধিসৌধের ছাদের নকশা।

নকশাকৃত দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। সমাধি ভবনের ভেতরে দুটি বড় ও চারটি অপেক্ষাকৃত ছোট কবর রয়েছে। এর মধ্যে বড় দুটি ইসা খান ও তার স্ত্রীর। এই দুটি কবর মার্বেল ও লোল বেলেপাথর দিয়ে এবং বাকী চারটি পাথর খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে। তবে ভবনের ভেতর ঠিক মাঝে দাঁড়ালে সবচেয়ে যে জিনিসটি বেশি দৃষ্টি আকর্ষন করবে সেটি হলো ছাদের মাঝখানের গোলাকৃতি নকশাটি। লাল, নীল ও সবুজ রং-এর নকশাটি আমাদের দেশীয় নকশী কথার কথাই মনে করিয়ে দিল। ছাদের বাকী নকশাগুলো অবশ্য কালের বিবর্তনে কিছুটা বিবর্ণ হয়ে গেছে।
সমাধি সংলগ্ন মসজিদ।

মসজিদের ভেতরের দৃশ্য। ছবি তুলেছেন Ronakshah1990

সমাধি ভবনের পাশেই রয়েছে সংলগ্ন মসজিদটি। এর দেয়ালগুলোও লাল বেলেপাথর ও মার্বেল দিয়ে তৈরি করা হয়েছে। সামনের খালি জায়গায় একটি অব্যবহৃত কূপ রয়েছে। মসজিদের কোণায় ভেতরের দিকে ছাদে উঠার একটি সিঁড়ি রয়েছে। অন্ধকারে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠার চেষ্ঠা করেছিলাম কিন্তু কয়েকটি বাদুর তাদের উপস্থিতি জানান দেয়ায় ক্ষ্যান্ত দিতে হল। মসজিদের পাশ দিয়েই বাইরের দিকে বেষ্ঠনী দেয়ালে উঠার সিঁড়ি রয়েছে কিন্তু সেখানে নিরাপত্তাজনিত কারনে উঠা নিষেধ (গার্ড আশেপাশে না থাকলে অবশ্য আপনি উঠে দেখতে পারেন 😉)। পুরো কমপ্লেক্সটি ৪০ মিনিটের মত ঘুরে দেখার পর আমরা হুমায়ুনের সমাধির দিকে পা বাড়ালাম।

পাদটীকা: প্রচ্ছদের ছবিটি তুলেছেন বোধিসত্ত্ব দা। তাহার প্রতি কৃতজ্ঞতা।