লেক কমো: সুউচ্চ পর্বত ও নীল জলরাশি যেখানে এক হয়েছে

আল্পস পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ের সারি বেয়ে নীল রং-এর বাসটি আঁকাবাঁকা পিচঢালা পথে নেমে যাচ্ছে সরাসরি ১২০০০ ফুট নিচে। গন্তব্য, মিলান থেকে ৬০ কিলোমিটার উত্তরে সুইজারল্যান্ডের সীমান্ত ঘেঁষা ইউড়োপের অন্যতম গভীরতম জলাভূমি লেক কমো। রাস্তার একপাশে পাহাড় সগর্বে দাড়িঁয়ে; অপর পাশে সরু লোহার রেলিং। সাদা রং করা রেলিংগুলো আমার কাছে কেবলই কৌতুক মনে হচ্ছিল। কারণ বারবারই এই ভয় উঁকি দিচ্ছিল যে, যদি বাসটি কোনভাবে রাস্তা ভুল করে সোজা পাহাড় বেয়ে নামার চেষ্ঠা করে তাহলে এই রেলিংগুলো কতটা উপকারে আসবে। যদিও এগুলো রাস্তা নির্দেশ করতেই ব্যবহার করা হয়েছে। ভয় ও শীতের সাথে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত অবশ্য জানালা দিয়ে সৌন্দর্য উপভোগে মনোনিবেশ করা গেল।

২০০০ বছর ধরে ইতালির এই ভ্যাকেশন স্পটটি রোমান জেনারেল থেকে শুর করে হালের ম্যাডনা ও জর্জ ক্লুনিদের কাছে অবসর কাটানোর অন্যতম একটি জনপ্রিয় স্থানে পরিণত হয়েছে লেক কমোর নীল জল ও পার্বত্য গাছপালার সবুজের সংমিশ্রণে তৈরি অপার সৌন্দর্যের কারনে। আল্পস পর্বতের পাদদেশে অবস্থিত চারপাশে পাহাড় পরিবেষ্ঠিত এই লেকটিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু গ্রাম; পাওয়া যায় সিল্কের তৈরি জনপ্রিয় জিনিসপত্র। তবে লেকটি ছাড়াও এ স্থানটি জনপ্রিয় এখানকার ভিলা বা প্যালেসগুলোর জন্য। লেক কমোর পার ঘেঁষে রয়েছে বেশ কিছু ঐতিহাসিক ভিলা।

লেকের পার থেকে ভ্যারেনা গ্রাম

আমাদের বাস যাত্রা শুরু হয়েছিল লেক কমো থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের ছোট গ্রাম এসিনো লারিও থেকে। লেক কমোর গ্রামগুলোর মধ্যে একটির নাম ভ্যারেনা; সেটিই ছিল আমাদের গন্তব্য। ভ্যারেনাতে ছোট একটি রেল স্টেশনের সামনেই আমরা বাস থেকে নেমে গেলাম। সেখান থেকে ৫/৭ মিনিটের মতন পায়ে হেঁটে নেমে গেলাম আরও নিচে অর্থাৎ লেক কমো। পাহাড়ের পানিগুলো যাতে যত্রতত্র নেমে নিচের গ্রামের ও লেকের সব অংশের পানি নোংরা না হয় তার জন্য বেশ প্রশস্থ একটি ড্রেন তৈরি করা হয়েছে যেটা পাহাড়ের পাদদেশ থেকে শুরু হয়ে একেবারে লেকের একটি অংশে শেষ হয়েছে; তবে ড্রেন হিসেবে একটু বেশিই পরিষ্কার। রাস্তার পাশের ম্যানহোলের ঢাকনা ছাড়া ড্রেনগুলো দেখতে অভ্যস্থ আমার কাছে এটি ছোটখাটো একটি খালই মনে হল।

লেক কমো

ড্রেনটির পার ধরে হাঁটতে হাঁঠতে আমরা এসে পৌঁছলাম লেকের পারে। এ পর্যায়ে এসে একটি কথা স্বীকার করতেই হয়। অনেক মানুষই সুন্দর কিছু দেখলে ইন্সট্যান্ট প্রেমে পড়িয়া যায়, আমি ঠিক অমন টাইপের নই। মানুষ যখন সুন্দরের প্রেমে পড়িয়া তাহার পূজা আরম্ভ করিয়াছে; সেই সময়টুকু আমার বুঝতে বুঝতেই চলিয়া যায়। সুতরাং সুন্দর বুঝাইতে এবার আমাকে রবি ঠাকুরের সাহায্য লইতে হইবে। তাহার ছত্রগুলো কিঞ্চিৎ ইডিট করিলে আমার ভাবার্থ অনেকটাই,

জ্যোতির্বিদ যেমন নক্ষত্রোদ্বয়ের অপেক্ষায় আকাশের দিকে তাকাইয়া থাকে আমিও যে তেমনি অপার নীল জলরাশি পানে অপলক দৃষ্টিতে চাহিয়া দেখিতেছিলাম সে কথা অস্বীকার করিতে পারিব না। ভক্তের সেই ব্যাকুল দৃষ্টিক্ষেপ সার্থকও হইয়াছিল। সেই সবুজের বন বয়ে হাওয়াগুলো যখন নীল জল ছুঁয়েছিল তখন শান্তস্নিগ্ধ জ্যোতি প্রতিবিম্বিত হইয়া আমার সমস্ত চিত্তক্ষোভ মুহূর্তে দমন হইয়া গেল।

যে জায়গাটিতে এসে দাঁড়ালাম সেখানে বেশ বড় কয়েকটি গাছের গোড়ায় চাকতির মত বসার স্থান তৈরি করা হয়েছে। সেখানে বসে নিশ্চিন্তে পুরো লেকের অংশটা অনায়শে উপভোগ করা যায়। দুপুরের রোদে লেকের পারে ঘুরতে ঘুরতে ক্লন্ত হয়ে গেলেও চিন্তা নেই; বসে পড়ুন আর উপভোগ করুন পার্বত্য হওয়া। আমরা যেখানে রয়েছি, তার একপাশে ছোট একটি কৃত্তিম নুড়ি পাথরের বিচ ও রেস্তোরা রয়েছে। সেখানে ২ ইউড়ো দিয়ে আপনি অনায়শে কিছুক্ষণের জন্য লেকের পানিতে সাঁতারও কাটতে পারবেন।

লেক কমো ও এর আশেপাশের গ্রাম; ছবি তুলেছেন ক্যাসিনাম

ভ্যারেনা গ্রামটি লেকের পূর্ব দিকে অবিস্থত। লেক ছাড়াও ইউরোপীয় স্থাপত্যে পাহাড়ি বাড়িগুলোও আপনার নজড় কাড়তে বাধ্য। ১১শ শতক থেকে এ গ্রামের লোকজন মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে; হালের দিকে এ কথাটা কতটুকু সত্য তার জন্য অবশ্য গবেষণার প্রয়োজন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, গ্রামটি আরও আগে ৭৬৯ এর দিকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন স্থানীয় কোন একজন জেলে। পাড় ধরে হাঁটলে চোখে পড়বে সাড়ি সাড়ি রেস্তোরা, শিশুদের ছোট ছোট প্লেগ্রাউন্ড ও বিভিন্ন সুভ্যানিয়ারের দোকান। পাশেই রয়েছে বেশ কয়েকটি ছোট ছোট ঘাট; নির্দিষ্ট সময় পরপর পর্যটক নিয়ে ছোট ছোট বোটগুলো সেখান থেকে চলাচল করে লেকের এক পাশ থেকে অন্য পাশে।

লেক কমো ও এর আশেপাশের গ্রাম; ছবি তুলেছেন ক্যাসিনাম

লেকের পার দিয়ে গড়ে উঠা ঐতিহাসিক ভিলাগুলোর মধ্যে কয়েকটি বর্তমানে ধনী-প্লেবয়দের রিসোর্টে পরিণত হয়েছে। ম্যাডোনা, জন ক্যারি, রোনালদিনহো, সিলভ্যাস্টার স্ট্যালন ও জর্জ ক্লুনিদের মত তারকারা পাপারাজ্জিদের হাত থেকে বাঁচার জন্য অবকাশ কেন্দ্র হিসেবে লেক কমোতে নিজেদের কেনা রিসোর্টে মাঝে মাঝেই চলে আসেন। তৎকালীন বেশ কয়েকজন রোমান দার্শেনিক ও লেখকের জন্মস্থানও এটি। আবার কৌশলগত কারণে রোমান সাম্রাজ্যেও এর অসীম গুরুত্ব ছিল।

আপনি অবকাশ যাপন, সৌন্দোর্য আরোহণ, রোমান্টিকতা- যে উদ্দেশ্যেই স্থানটি ভ্রমণ করেন না কেনো সেটা পূরণ হতে বাধ্য। খুশির খবর হল, আপনি যেকোন স্থানে দাঁড়িয়ে যেদিকে ঘুরেই সেলফি তুলেন না কেনো সেটা সুন্দর হবেই হবে; মুখ বাঁকা থাক বা না থাক। ইহা এমন একটি স্থান যেখানে ফটোশপের প্রয়োজনীয়তা প্রায় শূণ্যের কোঠায় 🙂

পাদটীকা: প্রচ্ছদের ছবিটি তুলেছেন তানভির মোর্শেদ। তাহার প্রতি কৃতজ্ঞতা।

যাত্রাপথে ও ভ্যারেনাতে ১ মিনিটের একটি ভিডিও করেছিলাম: