উইকি লাভস মনুমেন্টস – বিশ্বের সবচেয়ে বড় ছবি প্রতিযোগিতা

বাংলাদেশে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসব্যাপী চলে দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নিয়ে উইকিপিডিয়ার ছবি তোলার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ‘উইকি লাভস মনুমেন্টস’। এটি গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডধারী বিশ্বের সবচেয়ে বড় আলোকচিত্র প্রতিযোগিতা।

২০১৬ সাল থেকে প্রতিযোগিতাটি বাংলাদেশে আয়োজন করছে উইকিপিডিয়া নিয়ে কাজ করা অলাভজনক সংস্থা ‘উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ’।

উইকি লাভস মনুমেন্টস কী?

‘উইকি লাভস মনুমেন্টস’, যা সংক্ষেপে ‘ডাব্লিউএলএম’ নামে পরিচিত একটি বার্ষিক আন্তর্জাতিক ছবি তোলার প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতাটি প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী দেশগুলো নিজ নিজ সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার ছবি নিয়ে অংশগ্রহণ করে। প্রতিযোগীতায় অংশগ্রহণকারীরা নিজ দেশের ঐতিহ্যবাহী স্থাপানার ছবি ধারণ করে উইকিপিডিয়ার সহ-প্রকল্প এবং উন্মুক্ত ছবির ভাণ্ডার উইকিমিডিয়া কমন্সে (https://commons.wikimedia.org) আপলোড করে থাকেন।

মুক্ত বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়ার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার জন্যই মূলত প্রতিযোগিতাটি আয়োজন করা হয়। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের এমন স্থাপনার আলোকচিত্রের স্থায়ী সংগ্রহশালা তৈরির পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষার উইকিমিডিয়া প্রকল্পসমূহে (যেমন, উইকিপিডিয়া, উইকিভ্রমণ) ছবিগুলো ব্যবহারের মধ্য দিয়ে সংশ্লিষ্ঠ স্থাপনাটি বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করাই প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য।

আরও পড়ুন: আপনিও হতে পারেন উইকিপিডিয়া অবদানকারী

২০১০ সালে নেদারল্যান্ডে প্রতিযোগিতাটি শুরু হলেও দ্রুত অন্যান্য দেশে এটি জনপ্রিয় হয়ে উঠে এবং ২০১২ সালে গিনেস বুকে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় আলোকচিত্র প্রতিযোগিতা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ৮৬টি দেশের ২২ লক্ষ আলোকচিত্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে জমা পড়ে। ২০১৮ সালে প্রতিযোগিতায় ৫৬টি দেশের ১৪ হাজার আলোকচিত্রী ২ লক্ষ ৫৮ হাজার আলোকচিত্র জমা দিয়েছিলেন।

প্রতিযোগিতা শেষে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দেশ থেকে প্রাপ্ত ১০টি করে আলোকচিত্র থেকে ১৫টি আলোকচিত্রকে আন্তর্জাতিক বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। আন্তর্জাতিকভাবে বিজয়ীদের বিভিন্ন পুরস্কার প্রদান করা হয়। এছাড়া স্থানীয় পর্যায়েও সতন্ত্রভাবে পুরস্কার প্রদান করা হয়ে থাকে।

বাংলাদেশে আয়োজনের ইতিহাস

আজিম খান রনির তোলা তোলা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের এই ছবিটি ২০১৭ সালে আন্তর্জাতিক তালিকায় তৃতীয় স্থান লাভ করে।

২০১৬ সালে বাংলাদেশে প্রতিযোগিতাটি প্রথম অনুষ্ঠিত হয়। এরপর থেকে প্রতি বছরই এটি আয়োজন করা হচ্ছে। প্রথম থেকেই বাংলাদেশে এ প্রতিযোগিতা আয়োজন করছে ‘উইকিমিডিয়া বাংলাদেশ’। প্রতিযোগিতার আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, অংশগ্রহণকারী স্ব-স্ব দেশের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলো হবে প্রতিযোগিতার বিষয়। প্রথম বছর বাংলাদেশ থেকে শুধুমাত্র দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা নিয়ে অংশ নেওয়া হয়েছিল।

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের হিসেব অনুযায়ী, বরিশাল বিভাগে ২০টি, চট্টগ্রাম বিভাগে ৪৯টি, ঢাকা বিভাগে ৮৮টি, খুলনা বিভাগে ৮১টি, রাজশাহী বিভাগে ১৩৪টি, রংপুর বিভাগে ৫০টি, সিলেট বিভাগে ১৩টি ও ময়মনসিংহ বিভাগে ১৭টি স্থাপনাসহ মোট ৪৫২টি স্থাপনার ছবি নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিল বাংলাদেশ। ২০১৭ সাল থেকে তালিকাতে প্রত্নতত্ত্বের বাইরে দেশের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাও যুক্ত করা হয়।

প্রতিযোগিতায় কোন দেশের অংশগ্রহণের আরও একটি নিয়ম হলো প্রতিটি তালিকাভুক্ত স্থাপনার ইউনিক আইডি নাম্বার থাকতে হবে। আমাদের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার যেহেতু সরকারিভাবে এমন আইডি নেই সেহেতু আমাদের আইএসও কোড মেনে প্রতিটি স্থাপনার জন্য একটি করে ইউনিক আইডিও বানাতে হয়েছে। উদাহরণস্বরুপ, কোন স্থাপনার কোড যদি BD-C-13-1 হয়, সেক্ষেত্রে এখানে BD হল দেশের কোড, C হল স্থাপনাটি যে বিভাগে অবস্থিত সেই বিভাগের আইএসও ৩১৬৬-২ কোড, 13 হল যে জেলায় অবস্থিত সে জেলার আইএসও ৩১৬৬-২ কোড এবং সবশেষে ক্রমিক নম্বর।

আব্দুল মুমিনের তোলা রাজশাহীর পুঠিয়া রাজবাড়ির পঞ্চরত্ন গোবিন্দ মন্দিরের এই ছবিটি ২০১৮ সালে চতুর্থ স্থান লাভ করে।

শুরু থেকেই উইকিমিডিয়া বাংলাদেশের পক্ষে আমি প্রতিযোগিতাটি সমন্বয় করে আসছি। আমরা সব সময়ই উইকিমিডিয়া বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ইন্টারনেটে বাংলা ভাষার বিষয়বস্তু বা কনটেন্ট সমৃদ্ধ করা অথবা বাংলাদেশকে কীভাবে উইকিপিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বদরবারে উপস্থাপন করা যায় সেটার উপর গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। ছবি প্রতিযোগিতাটি যেহেতু আন্তর্জাতিক সেহেতু এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্য বিশ্বের সামনে তুলে ধরার এটি অন্যতম বড় একটি মঞ্চ। এটি প্রতিযোগিতা আয়োজনের অন্যতম একটি কারণও বটে। আমরা প্রতিযোগিতাটি ২০১৬ সালে যখন শুরু করি সে সময় এসব প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনার মুক্ত লাইসেন্সের কোন ছবি ছিল না বললেই চলে।

আরও পড়ুন: কীভাবে উইকিমিডিয়া কমন্সে ছবি আপলোড করবেন?

প্রতিযোগিতার প্রথম বছরে আমরা তালিকাভুক্ত ৪৫২টি স্থাপনার মধ্যে ২৭০টির বেশি স্থাপনার প্রায় ৭ হাজার ছবির সংগ্রহশালা তৈরিতে সমর্থ হই। সাথে সাথে আমরা সে বছর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো সম্পর্কে উইকিপিডিয়াতে নিবন্ধ তৈরি শুরু করি (আমি নিজে ৬০+ নিবন্ধ তৈরি করেছিলাম)। সে সময় বাংলা উইকিপিডিয়ায় মোট ১৭৮টি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা সম্পর্কে নতুন নিবন্ধ যুক্ত হয়।

এই প্রতিযোগিতাটি বাংলাদেশে আয়োজনের অন্যতম বড় একটি উদ্দেশ্য ছিল, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার মুক্ত লাইসেন্সের ছবির একটি স্থায়ী সংগ্রহশালা তৈরি যাতে ছবিগুলো যে কেউ আলোকচিত্রীকে কৃতিত্ব প্রদানপূর্বক মুক্তভাবে ব্যবহার করতে পারেন। এই ব্লগ লেখা পর্যন্ত আমাদের কাছে বর্তমানে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার এমন ১৬ হাজারের বেশি ছবির সংগ্রহশালা রয়েছে। আমাদের বড় প্রাপ্তি হল আমরা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে প্রায় সবগুলো স্থাপনার ছবি সংগ্রহ করতে পেরেছি।

বাংলাদেশের সাফল্য ও পুরস্কার

২০১৮ সালে পঞ্চদশ স্থান লাভ করে শাহরিয়ার আমিনের তোলা দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কুয়াশাচ্ছন্ন এই ছবিটি।

২০১৬ সালে প্রথমবার আমাদের কোন ছবি আন্তর্জাতিকভাবে বিজয়ী তালিকাতে স্থান পায়নি। তবে ২০১৭ সাল থেকে সেটি পরিবর্তন হয়ে যায়। সে বছর বিশ্বের ৫৪টি দেশের ছবির সাথে প্রতিযোগিতা করে দেশের ২টি ছবি আন্তর্জাতিকভাবে সেরা ১০-এ স্থান করে নেয়। ১০টি ছবির মধ্যে বাংলাদেশের আজিম খান রনির তোলা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের একটি ছবি তৃতীয় এবং জুবায়ের বিন ইকবালের তোলা বায়তুল মোকাররমের আরেকটি ছবি ৭ম লাভ করে।

২০১৮ সালে বিশ্বের ৫৬টি দেশের ছবির সাথে প্রতিযোগিতা করে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো ১০টি ছবির মধ্যে ৪টি ছবি আন্তর্জাতিকভাবে সেরা ১৫-তে স্থান করে নেয়।

এরমধ্যে, আব্দুল মোমিনের তোলা রাজশাহীর প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য পুঠিয়া রাজবাড়ির পঞ্চরত্ন গোবিন্দ মন্দিরের আলোকচিত্র চতুর্থ, শাহরিয়ার আমিন ফাহিমের তোলা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের একটি আলোকচিত্র পঞ্চম, ১১তম স্থানে নাজমুল হাসানের তোলা বায়তুল মোকাররমের আরও একটি আলোকচিত্র ও ১৫তম স্থানে ছিল শাহরিয়ার আমিনের তোলা দেশের সবচেয়ে দীর্ঘ রেলসেতু হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কুয়াশাচ্ছন্ন একটি আলোকচিত্র।

যদিও আন্তর্জাতিকভাবে সেরা ১৫টি ছবি প্রকাশ করা হয় কিন্তু সে বছর বাংলাদেশের পাঠানো আরও দুটি ছবি ১৭ ও ২১তম স্থানে ছিল। অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে পাঠানো ১০টি ছবির মধ্যে ৬টিই সেরা ২৫-এ স্থান পেয়েছিল।

আরও পড়ুন: বাংলা উইকিপিডিয়া – আসুন সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় একটি পূর্ণাঙ্গ বাংলা বিশ্বকোষ গড়ে তুলি

২০১৯ সালের আগস্টে সুইডেনের স্টকহোম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত উইকিপিডিয়ার বার্ষিক সম্মেলন উইকিম্যানিয়াতে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতার সাফল্য নিয়ে একটি কেইস স্টাডি উপস্থাপন করেছি। সেখানে সবাই বাংলাদেশের প্রতিযোগিতার প্রশংসা করেছেন।

উইকি লাভস মনুমেন্টস প্রতিযোগিতা যেহেতু বিশ্বের গুরত্বপূর্ণ ও বৃহৎ আলোকচিত্র প্রতিযোগিতা সেহেতু এতে আন্তর্জাতিক স্কীকৃতি অর্জনের পাশাপাশি রয়েছে পুরস্কার জেতার সুযোগ। সাধারণত, প্রতি বছর আন্তর্জাতিকভাবে সেরা ১৫টি ছবির জন্য ৩০০০ হাজার ইউরো থেকে ২০০ ইউরো সমমূল্যের অ্যামাজন গিফ্ট ভাউচার, সার্টিফিকেটসহ আরও অন্যান্য পুরস্কার প্রদান করা হয়।

আন্তর্জাতিক পুরস্কার ছাড়াও বাংলাদেশে থেকে সেরা যে ১০টি ছবি নির্বাচন করা হয় তাঁদের জন্য বিভিন্ন মূল্যের গিফ্ট ভাউচার, উইকিপিডিয়ার টি-শার্ট, সার্টিফিকেটসহ বিভিন্ন পুরস্কার থাকে।

প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ও নিয়ম

প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ থেকে অংশগ্রহণের জন্য www.wikiloves.org/monuments -এ ঠিকানায় গিয়ে সেপ্টেম্বর মাসে ছবি আপলোড করতে হয়। এ ঠিকানায় কোন কোন স্থাপনার ছবি দেওয়া যাবে তার তালিকা দেওয়া আছে। শুরুতে উইকিমিডিয়া কমন্সে প্রবেশ করে একটি নতুন অ্যাকাউন্ট তৈরি করতে হয় (যদি না থাকে)। এরপর ব্যবহারকারী যে ছবিটি আপলোড করতে চান সেটির একটি সঠিক নাম দিতে হবে। একজন অংশগ্রহণকারী যত খুশি তত ছবি আপলোড করতে পারেন। তালিকার প্রতিটি নামের পাশে আপলোড বাটন রয়েছে যেখানে ক্লিক করে ওই নির্দিষ্ট স্থানের ছবি আপলোড করতে হবে।

ছবি আপলোডের ক্ষেত্রে রয়েছে কিছু শর্তও। আগ্রহী আপলোডকারীর সব ছবি অবশ্যই নিজের তোলা হতে হবে। জলছাপযুক্ত ছবি প্রতিযোগিতায় গ্রহণযোগ্য নয়। ছবি বছরের যেকোনো সময়ের তোলা হলেও সব ছবি শুধুমাত্র সেপ্টেম্বরে প্রতিযোগিতা চলাকালীন আপলোড করা হতে হবে। একজন অংশগ্রহণকারী যেসব ছবি প্রতিযোগিতায় জমা দিবেন তখন ছবিগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে উন্মুক্ত লাইসেন্স ক্রিয়েটিভ কমন্স লাইসেন্স অর্থাৎ ‘সিসি বাই-এসএ ৪.০’ নামে পরিচিত লাইসেন্সে থাকবে। এখানে ছবির কোয়ালিটি দেখে বিচার করা হয়, ব্যক্তি দেখে নয়। সুতরাং একই ব্যক্তি কয়েকটি পুরস্কারও পেতে পারেন।

যে সব স্থাপনার ছবি দেওয়া যাবে

প্রয়োজনীয় লিংক

চিত্র কৃতিত্ব: পোস্টের কাভার ছবিটি তুলেছেন আজিম খান রনি যা সিসি-বাই-এসএ ৪.০ লাইসেন্সের আওতায় উইকিমিডিয়া কমন্সে প্রকাশিত।